রুকইয়াহ কি এবং কেন?

রুকইয়াহ কি ?

রুকইয়াহ হচ্ছে একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। সাধারণত রুকইয়াহ শব্দের অর্থ হচ্ছে: ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র, দোয়া পড়া ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থে রুকইয়াহ বলতে বোঝায় কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সুন্নাহ সম্মত উপায়ে রাসুল সাঃ এর দেখানো পদ্ধতিতে জিন, যাদু, কুফরী, বান, ওয়াসওয়াসা, বদনজর ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা করাকেই আমরা রুকইয়াহ বলে থাকি। অর্থাৎ যাকে রুকইয়াহ শারইয়াহ বলা হয়ে থাকে। আর এই রুইকইয়াহ সেবা যারা দিয়ে থাকেন তাদের কে রাকী বলা হয়ে থাকে।

দিন যতই যাচ্ছে রুকইয়াহ শব্দটি ততই মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করছে। আগে মানুষ রুকইয়াহ শব্দটির সাথে তেমন একটা পরিচিত ছিলোনা। মানুষ এই শব্দটিকে ঝাড়ফুঁক , দোয়া, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন নামে জানতো। কিন্ত মাশা আল্লাহ বর্তমানে দিন যতই এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ এই শব্দটি এবং রুকইয়াহ চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে ততই পরিচিতি লাভ করছে। নিম্নে আমরা এই রুকইয়াহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

রুকইয়াহ চিকিৎসা পদ্ধতিটি বৈধ হওয়ার জন্য ফক্বিহদের মতে  কতিপয় শর্ত রয়েছে যা পূরণ হওয়া আবশ্যক।

১) রুকইয়াহ চিকিৎসার মধ্যে কোন ধরনের শিরক ও কুফরের সংমিশ্রণ থাকা যাবেনা।
২) রোগী এবং রাকী উভয়ই ঝাড়ফুঁকের নিজের কোন ক্ষমতা আছে; এই ধরনের বিশ্বাস বা আকিদা না রাখা। বরং বিশ্বাস করা, মহান আল্লাহর হুকুমেই এর দ্বারা আরোগ্য লাভ করা হয়।
৩) রুকইয়াতে পাঠ করা প্রতিটি দোয়া বা মন্ত্র যেনো স্পষ্ট আরবী ভাষায় হয়।
৪) যদি অন্য ভাষায় হয়, তবে এমন হওয়া; যার অর্থ স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।

ইসলামি পন্ডিতদের মতে রুকইয়া করার পূর্বে এই আক্বিদা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া উচিত ‘রুকইয়াহ বা ঝাড়ফুঁকের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, সব ক্ষমতা আল্লাহ তা’আলার, আল্লাহ চাইলে শিফা হবে, নয়তো হবে না।’

প্রকারভেদের দিক দিয়ে রুকইয়াহ প্রধানত দুই প্রকার:

১) রুকইয়াহ্‌ শারইয়্যাহ্‌

২) রুকইয়াহ্‌ শিরকিয়্যাহ্‌

রুকইয়াহ্‌ শারইয়্যাহ্‌ :
রাসুল সা: এর দেখানো পদ্ধতিতে কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জিন, যাদু, হাসাদ, বদনজর, ওয়াসওয়াসা, ও আরো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সেবা দেওয়াকেই রুকইয়াহ শারইয়াহ বলে। অর্থাৎ যে রুকইয়াহ সেবা এর মধ্যে কোনো ধরনের শির্ক ও হারামের সংমিশ্রণ থাকবেনা এবং তা হবে সম্পুর্ন শারইয়াহ পদ্ধতিতে তাকেই রুকইয়াহ শারইয়াহ বলে।

রুকইয়াহ্‌ শিরকিয়্যাহ্‌:
রুকইয়াহ শিরকিয়াহ হচ্ছে রুকইয়াহ শারইয়াহ এর সম্পুর্ন এর বিপরীত। যে রুকইয়াহ চিকিৎসায় সম্পুর্ন শিরকি তন্ত্রমত্র দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা হয় বা চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। তাকেই রুকইয়াহ শিরকিয়াহ বলে। অর্থাৎ আমরা যারা বিভিন্ন হিন্দু কবিরাজ বা আমাদের নিজেদেরই নামধারী কিছু মুসলিম ভাই দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে থাকি, যারা কুরআন সুন্নাহ ছাড়া সম্পুর্ন শিরকি তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে এবং অদ্ভুত পদ্ধতিতে যে চিকিৎসা সেবা দেয় তাই রুকইয়াহ শিরকিয়াহ। যাকে আমাদের নিজ নিজ এলাকার ভাষায় কুফরী কালাম, বান, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি বলে থাকি।

এ ধরনের রাকি বা কবিরাজ গুলো ঈমান হারা হয়ে থাকে। এদের দারা রোগীরা চিকিৎসার নামে প্রতারিত হয়ে থাকে। রোগীদের তো তেমন কোনো ফায়দা হয়না বরং রোগীর সমস্যা পূর্বের চেয়ে বেড়ে যায়। এবং অনেক ক্ষেত্রে এই কাজ টা এইসব ভন্ড অসাধু কবিরাজরাই করে থাকে, তারা তাদের পালিত জিন বা নিজেদের তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে রোগীকে দিনের পর দিন অসুস্থ বানিয়ে রাখে এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সরলমনা রোগীদের থেকে চিকিৎসার নামে অর্থ হাসিল করে থাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই ধরনের চিকিৎসা পদ্দতি গ্রহনের কারনে রোগী যেমন গুনাহগার হয় এবং ঈমান হারানোর আসংকা ও থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের এইসব মানুষ নামধারী ইবলিস থেকে হিফাজত করুক আমীন।

আমরা কিভাবে রুকইয়াহ করতে পারি?

প্রথমতঃ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা নিজেই নিজের রুকইয়াহ করতে পারি। বা কুরআনের আয়াত জানা না থাকলে রুকইয়াহ এর বিভিন্ন অডিও শুনতে পারি যাকে আমরা সেল্ফ রুকইয়াহ বলে থাকি, এবং আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যের উপর ও রুকইয়াহ করতে পারি।

দ্বিতীয়তঃ কুরআন সুন্নাহভিত্তিক বিশ্বস্ত কোনো রাকী দিয়ে রুকইয়াহ করতে পারি। সেল্ফ রুকইয়াহ বা নিজেই নিজের রুকইয়াহ করা সব সময় সহজ হয়না কারন এতে যেমনি ধৈর্য্য বা সাহসের প্রয়োজন তেমনিভাবে রুকইয়ার আয়াত গুলো নির্দিষ্ট সময় ধরে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক। কারন আপনি যখন সেল্ফ রুকইয়াহ বা নিজেই নিজের রুকইয়াহ করবেন তখন আপনার শরীরের অস্বস্তি যন্ত্রণা অধিক মাত্রায় বেড়ে যাবে এবং অনেক সময় জিন ও চলে আসতে পারে শরীরে। তখন আমাদের অনেক সরলমনা মা বোন, ও ভাইয়েরা, ভয়ে আর রুকইয়াহ কন্টিনিউ করতে চায়না। যার ফলে রোগী আর সুস্থতার দেখা পায়না সহজে। কিন্তু যারা প্রতিনিয়ত সাহস করে নিজেই নিজের রুকইয়াহ করা চালিয়ে যেতে পারেন তারা ইন শা আল্লাহ সফলতা অর্জন করে এবং আল্লাহর অশেষ কৃপায় আরোগ্য লাভ করেন। নিজেই নিজের রুকইয়াহ চিকিৎসা পদ্ধতি সবার দারা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়না। এর ফলাফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুন্য হয়। যার কারনে আমরা সাজেস্ট করি বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ কোনো রাকী যিনি কুরয়ান সুন্নাহর মানদণ্ডে রুকইয়াহ সেবা দিয়ে থাকেন তার শরনাপন্ন হওয়া।

ভালো রাকি বা কবিরাজ চেনার উপায় কি?

ভালো রাকি বা কবিরাজ চেনার উপায় হচ্ছে, রুকইয়াহ চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোন ধরনের শির্ক বা হারামের সংমিশ্রণ থাকবেনা। এরা সম্পুর্ন কুরআন ও হাদিসে বর্নিত দোয়া কালামের মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক পানি পড়া তেল পড়া ইত্যাদি দিয়ে থাকবেন। চিকিৎসার জন্য কখনই রোগীর নাম রোগীর মায়ের নাম বাবার না ইত্যাদি চাইবেনা। কোনো ধরনের জিনিসপত্র বা অংগপতং চাইবেনা যেমন: ব্যবহৃত জামা, চুল, নক, রক্ত, হাড় ইত্যাদি। বিশেষ করে মহিলাদেরকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পর্দার অবলম্বন করবে। চিকিৎসার সময় মহিলাদের গাতে হাত চিকিৎসা দেওয়া থেকে দূরে থাকবে। এবং যাদের আকিদা হবে সম্পুর্ন বিশুদ্ধ, যারা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাকেই রোগের নিরাময় দাতা মনে করবেন। ইন শা আল্লাহ এই ধরনের লক্ষনগুলো বিদ্যমান থাকলেই ভালো রাকি হিসেবে শনাক্ত করতে পারবো।

রুকইয়ার কমন আয়াত সমূহ:

রুকইয়াহ যেহেতু একটা চিকিৎসা পদ্ধতি, তাই রোগের প্রকারভেদ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কুরআন ও হাদিসে বর্নিত আয়াত রয়েছে। যেমন ওয়াস ওয়াসার আয়াত, যাদুর আয়াত, বদনজরের আয়াত, হাসাদের আয়াত, জিন কে পুড়িয়ে দেওয়ার আয়াত ইত্যাদি, এই সকল আয়াত ও চিকিৎসা সম্বন্ধে আমরা আমাদের অন্য প্রবন্ধে আলোচনা করবো। কিন্ত সকল ধরনের চিকিৎসার রুকইয়াহ এর কিছু কমন আয়াত রয়েছে। যে আয়াত গুলোর দারা আমরা আমাদের সকল ধরনের বদনজর, জিন, যাদু, ইত্যাদি সমস্যা গুলোর চিকিৎসা করতে পারবো। এই আয়াত গুলোকে সাধারণত রুকইয়াহ এর কমন আয়াত বলা হয়ে থাকে। এই আয়াত গুলো পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রথমে নিয়ত করে নিতে হবে। হে মহান রব, রহমানুর রহিম আমার শরীরের বদনজর জিন যাদু কুফরি যত সমস্যা রয়েছে সব আপনি আপনার এই পবিত্র কালামের মাধ্যমে দূর করে দিন এবং আমাকে পরিপূর্ণ সুস্থতা দান করুন। এইভাবে নিয়ত করে দুরুদ শরীফের সহিত নিন্মোক্ত দোয়া গুলি পাঠ করতে। তাহলেই ইন শা আল্লাহ মহান রব আমাদের সুস্থতা দান করবেন।

রুকইয়ার কমন প্রসিদ্ধ কিছু আয়াতের তালিকা:

  • সুরা ফাতিহা
  • সুরা বাকারা ১-৫ আয়াত।
  • সুরা বাকারাহ ১০২ আয়াত
  • সুরা বাকারাহ ১৬৩-১৬৪ আয়াত
  • সুরা বাকারাহ ২৫৫ আয়াত।
  • সুরা বাকারাহ ২৮৫-২৮৬ আয়াত।
  • সুরা আলে ইমরান ১৮-১৯ আয়াত।
  • সুরা আ’রাফ ৫৪-৫৬ আয়াত।
  • সুরা আ’রাফ ১১৭-১২২ আয়াত।
  • সুরা ইউনুস ৮১-৮২ আয়াত।
  • সুরা ত্বহা ৬৯ আয়াত।
  • সুরা মু’মিনুন ১১৫-১১৮ আয়াত।
  • সুরা সফফাত ১-১০ আয়াত।
  • সুরা আহকাফ ২৯-৩২ আয়াত।
  • সুরা আর-রাহমান ৩৩-৩৬ আয়াত।
  • সুরা হাশর ২১-২৪ আয়াত।
  • সুরা জিন ১-৯ আয়াত
  • সুরা ইখলাস।
  • সুরা ফালাক।
  • সুরা নাস।

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম:

বর্তমানে আমরা রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। এই সংজ্ঞা টা মানতেই চাইনা। আমরা সব সময় রোগ হওয়ার পর প্রতিকারের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। কিন্ত এই রোগটা যে প্রতিরোধ করা সম্ভব বা যে পদ্ধতি গ্রহন করলে এই সমস্যা গুলো আমাদের ধারে কাছে ও আসতে পারে না। সেই পদ্ধতি গুলো না আমরা কখনো গ্রহন করি বা না আমরা জানি। এর মূল কারন হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। ছোট বেলা থেকেই আমাদের পাশ্চাত্যের অনুশাসনে বড় করা হয়। ধর্মীর অনুশাসনের ছোয়া আমাদের জীবনে প্রতিপন্ন হয়না যার ফলে আমরা ধর্মীয় জ্ঞ্যান থেকে হয়ে পড়ে মেধাশুন্য। তখন আমরা ও আমাদের দুনিয়াবি জীবনে হয়ে পড়ি বিপদগ্রস্ত যা থেকে কখনোই উত্তোলন হতে পারিনা। অথচ আমাদের ইসলাম ধর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে রেখেছেন। কিন্ত অজ্ঞতার কারনে আমরা এর সুফল ব্যবহার করতে পারছিনা। তাই আমাদের সকল সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সব সময় ধর্মীয় অনুশাসনে জীবন গড়তে হবে। এবং আমরা যেনো শুরু থেকেই কখনো জিন, যাদু, কুফরি, মানুষ শয়তান, জিন শয়তান এর ক্ষতিতে আক্রান্ত হতে না পারি সেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহন করবো। তাহলেই আমরা নিয়মিত সুস্থ থাকবো এবং কখনো কোনো রাকীর শরনাপন্ন হতে হবে না।

শেয়ার করুন: